*ভাঙন ঠেকাতে জরুরী প্রয়োজন ৩ কোটি টাকা
*আটকে আছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
*জরুরী প্রটেকশনের নামে জলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নদীমাতৃক অঞ্চল বরিশাল। মেঘনা, কীর্তনখোলা, আড়িয়াল খাঁ, সুগন্ধা, সন্ধ্যাসহ অসংখ্য নদী বয়ে গেছে এই অঞ্চলের কোল ঘেঁষে। তাই নদীর তীরবর্তী মানুষের বছর জুড়েই থাকতে হয় ভাঙন আতঙ্কে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম কিংবা জোয়ার এলেই নির্ঘুম রাত কাটে তাদের।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি বৃষ্টি এবং পানিবৃদ্ধির প্রভাবে নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এরই মধ্যে জেলার ৬টি উপজেলার ১২টি পয়েন্টে ১৩শ মিটার জুড়ে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। যার কয়েকটি পয়েন্টে শুরু হয়েছে জরুরী প্রটেকশনের কাজও।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ‘বর্তমানে যেসব পয়েন্ট ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে সেসব এলাকায় ভাঙন রোধে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সেগুলো অনুমোদন না হওয়ায় জরুরী প্রটেকশনের নামে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে। এমন পরিস্থিতিতে নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণসহ গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন বিশেষ মহল। বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানাগেছে, সম্প্রতি উত্তর বঙ্গে পানি বন্যার কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ওই পানি নেমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বেড়ে যায়। তাছাড়া চলতি বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণের অধিকাংশ নদীই উত্তাল হয়ে ওঠে। তার উপরে গেলো কয়েক দিন ধরে পূর্ণিমার প্রভাবের পাশাপাশি পূর্ব-দক্ষিণমুখী বাতাস এবং উজানের চাপে কীর্তনখোলা, বুড়িশ্বর, সন্ধ্যা, নয়াভাঙ্গলি, তেতুলিয়া এবং মেঘনা-সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে যায় ভাঙনের তীব্রতা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে পানি বৃদ্ধির ফলে বরিশাল জেলার ৬টি উপজেলা সংলগ্ন নদীর ১২টি পয়েন্টের ১৩শ মিটার জুড়ে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে বরিশাল সদর উপজেলাধীন কীর্তনখোলা নদীর চরকাউয়া এলাকায় ১৫০ মিটার, চরমোনাই দরবার সংলগ্ন ৭০ মিটার, সদর উপজেলার সাহেবের হাট কড়াই তলানদীর রাজারহাট পয়েন্টে ২১৫ মিটার, হিজলা উপজেলার বদরটুনি স্কুল পয়েন্টে ৫০ মিটার, একই উপজেলার দক্ষিণ বাউশিয়া পয়েন্টে ১০০ মিটার, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চরবগি স্কুল পয়েন্টে ১০০ মিটার, বাবুগঞ্জ উপজেলার চোট মীরগঞ্জ বাজার সংলগ্নে ১০০ মিটার, চাঁদপাশা সিকদার বাড়ী পয়েন্টে ৫০ মিটার, মুলাদী উপজেলার নাজিরপুর লঞ্চঘাট ও পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্নে ৭০ মিটার ও বাকেরগঞ্জ উপজেলাধীন তেতুলিয়া নদীর দুর্গাপুর পয়েন্টে ২০০ মিটার জুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এরই মধ্যে হিজলার বদরটুনি স্কুল, দক্ষিণ বাউশিয়া, মেহেন্দিগঞ্জের চরবগি স্কুল ও বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা সিকদার বাড়ি পয়েন্টে নদী ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলে জরুরী ভিত্তিতে আপদকালীন প্রতিরোধমূলক কাজ চলমান রয়েছে। যাতে প্রায় কোটি টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে। তবে সকল পয়েন্টের ভাঙন রোধে কাজ শুরু করতে সব মিলিয়ে জরুরী ভিত্তিতে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপর একটি সূত্রে জানাগেছে, ‘কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী চরকাউয়া এলাকার ভাঙন রোধে ৩৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিমূলক এই প্রকল্পটি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে আটক আছে।
এছাড়া চরমোনাই ও লামছড়ির ভাঙন রোধে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দুটি নদীর মোহনায় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি চর কেটে নদী শ্মশান করা হবে। ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভাঙনের থেকে লামচড়ি, চরবাড়িয়া এবং চরমোনাই ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে আশাবাদী পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে নদী ভাঙনের হাত থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলা রক্ষায় ৬৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যা ডিপিপি আকারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। যা এখনো পানি উন্নয়ন বোর্ডেই ফাইল বন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
এছাড়া বাকেরগঞ্জ উপজেলাকে নদী ভাঙনের থেকে রক্ষায় ৭-৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে ৭শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ধুলিয়া নামের ওই প্রকল্পটি বোর্ড এবং মন্ত্রণালয় হয়ে একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই প্রকল্পটি অনুমোদনের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এটি বাস্তবায়ন হলে বাকেরগঞ্জ এবং পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলাকে তেতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে যে মেগা প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে বর্তমানে সেইসব এলাকায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। এ কারণে জরুরী প্রটেকশনের অংশ হিসেবে ওইসব এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এ জন্য প্রতিটি পয়েন্টে সর্বনি¤œ ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। এর পুরো টাকাটাই জলে যাচ্ছে। কেননা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ওইসব এলাকায় পুনরায় ভাঙন রোধে কাজ করা হবে। তাই ভাঙনে রোধে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বদলি জনিত কারণে ওই পদে নতুন কর্মকর্তা না থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া প্রধান প্রকৌশলী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন এবং মিটিং নিয়ে ব্যবস্তার কারণে তিনিও বক্তব্য দিতে পারেননি। যদিও ভাঙন রোধে গৃহীত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বরিশাল অঞ্চলকে নদী ভাঙনের থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। আর এজন্য বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম নিজে থেকেই জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল জানিয়েছেন।
Leave a Reply